
ধুম সকাল:
আমাদের প্রতিদিনের সকাল শুরু হয় খবরের কাগজ খুলে। আর সেই কাগজে চোখ রাখতেই নানা রঙের, আকর্ষণীয় কিংবা বিরক্তিকর, তথ্যবহুল কিংবা ভিত্তিহীন নানা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। ‘প্রচারে প্রসার’—এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে পণ্যের বাজারে চলছে প্রবল প্রতিযোগিতা। কে আগে মানুষের মন কাড়তে পারবে, সেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে চায় না কোনো প্রতিষ্ঠান।
তাই দেখা যায়, সরিষার তেল থেকে সয়াবিন, কোল্ড ড্রিংকস থেকে শাড়ি, জমি থেকে কলম, টয়লেট ক্লিনার থেকে বডি স্প্রে—প্রায় প্রতিটি জিনিসেরই বিজ্ঞাপন থাকে পত্রিকা, টেলিভিশন, বিলবোর্ড কিংবা সামাজিক মাধ্যমে। এমনকি পত্রিকার পাতায় ‘পাত্র চাই/পাত্রী চাই’ ঘরানার বিজ্ঞাপনও জায়গা করে নেয়, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যও ব্যবসায়িক ভাষায় সাজানো হয়।
প্রাচীন যুগে বিজ্ঞাপনের ছাপ
বিজ্ঞাপনের ইতিহাস বহু প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব যুগের মিশরে ব্যবসায়ীরা ‘প্যাপিরাস’ নামের কাগজে নিজেদের পণ্যের গুণাবলি লিখে প্রচার চালাত। রোমান সভ্যতা ও আরবদের মাঝেও বিজ্ঞাপনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চীনের ইনান শহরে খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ সালের দিকে ‘নিও ফ্যামিলি নিডল শপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ব্রোঞ্জের প্লেটে খোদাই করে সুই বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন:
“We buy high quality steel rods and make fine quality needles, to be ready for use at home in no time.”
(আমরা উন্নতমানের স্টিল রড কিনে সূক্ষ্ম সূচ তৈরি করি, যা খুব দ্রুত ঘরে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত।)
এই লেখায় আজকের বিজ্ঞাপনের ছায়াও দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞাপনের সূচনা
বাংলা হরফে বিজ্ঞাপনের ইতিহাস শুরু হয় ১৭৭৮ সালে। ইংরেজি সংবাদপত্র ‘Calcutta Chronicle’-এ পঞ্চানন কর্মকার একটি বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। এরপরে ধীরে ধীরে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন বাংলায় ছাপা হতে থাকে। সেসময়ের বিজ্ঞাপন ছিল সাদামাটা, সাদা-কালো ছবি আর মোটা হরফে গড়া।
কলকাতার ‘মতিলাল বসু এন্ড কোং’ এক বিজ্ঞাপনে দাবি করেছিল, তাদের তৈরি ‘লক্ষ্মীবিলাস তেল’ মাথা ব্যথা থেকে আরাম দেয়, পায়ের জ্বালা কমায়, এমনকি গন্ধে মাথা ঠান্ডা হয়! ম্যালেরিয়া সারায় এমন দাবিও ছিল। অবশ্য এসবের কোনো প্রমাণ বা গ্যারান্টি দেওয়া হয়নি।
নিমের বিজ্ঞাপন আর ‘মার্গো’র গল্প
‘ক্যালকাটা কেমিক্যাল’ কোম্পানি ছিল সেসময়ের অন্যতম জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। তারা নিম দিয়ে তৈরি করেছিল ‘মার্গো সাবান’, ‘নিম টুথপেস্ট’, ‘রেণুকা টয়লেট পাউডার’ ইত্যাদি। তখন বিলেতি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দেশীয় এই পণ্যগুলো ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এই কোম্পানিকে পরবর্তীতে হেঙ্কেল ইন্ডিয়া অধিগ্রহণ করে, যা এখন পরিচিত ‘জ্যোতি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড’ নামে।
নিম টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে বলা হতো—ছোটবেলা থেকেই দাঁতের যত্নে এই টুথপেস্ট ব্যবহার করুন। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই ভাষা আজকের বিজ্ঞাপনের সঙ্গেও প্রায় অভিন্ন!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বিজ্ঞাপনের মুখ
আজ যেভাবে তারকারা বিজ্ঞাপনের মুখ হন, তেমনি একসময় এই ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তিনি কেবল মুখই ছিলেন না, বিজ্ঞাপনের জন্য লেখাও লিখতেন।
‘কুন্তলীন’ কেশতেলের বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল—
“কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন :- কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নূতন কেশ হইয়াছে।”
এই বিজ্ঞাপন প্রায় ৭৬ বছর আগের। কুন্তলীন কোম্পানির কর্ণধার হেমেন্দ্র মোহন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে নয়, কবি নিজেও এই পণ্যে আস্থা রেখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন ‘রেডিয়ম ল্যাবরেটরি’-এর ক্রিম, স্নো, কেশতেল ও গ্লিসারিনের মতো পণ্য। তিনি লিখেছিলেন—
“রূপচর্চার জন্য রেডিয়ম ফ্যাক্টরির ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।”
এমনকি সেসময়ে জনপ্রিয় ‘সুলেখা কালি’র বিজ্ঞাপনেও তিনি বলেছিলেন—
“সুলেখা কালি, এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।”
এটা ছিল রসিকতা এবং প্রচারণা—দুয়ের অসাধারণ সংমিশ্রণ।
রবীন্দ্রনাথ: একাধিক পণ্যের প্রচারক
কবিগুরু প্রায় শতাধিক বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছিলেন—কখনো লেখক হিসেবে, কখনো স্রেফ মতামত দিয়ে। কাজলকালী নামের এক ধরনের কালি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “এর কালিমা বিদেশী কালির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।”
বোর্ন ভিটার নামের এক টনিক নিয়েও তাঁর মন্তব্য ছিল, “বোর্ন ভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি।”
এমনকি কলকাতার বিখ্যাত ‘জলযোগ’ মিষ্টির দোকান নিয়েও তিনি বলেছিলেন—
“জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে।”
রবীন্দ্রনাথ শুধু নিজের প্রয়োজনে এসব করেননি। শান্তিনিকেতনের আর্থিক সহায়তা জোগাড়, দেশি পণ্যের প্রচার এবং বন্ধুদের অনুরোধ, সবকিছুর সমন্বয়ে তিনি বিজ্ঞাপনের জগতে অবদান রেখেছেন।
একসময় মানুষের বিশ্বাস ছিল বিজ্ঞাপনের প্রতি। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকতো। আজ সেখান থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। এখন বিজ্ঞাপন মানেই অনেক সময় অতিরঞ্জন, মেকি ভাষা এবং ভুল তথ্য। তবে বিজ্ঞাপনের ইতিহাস ঘাটলে বোঝা যায়—মানুষের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে এবং সংস্কৃতির সঙ্গে বিজ্ঞাপনের সম্পর্ক বরাবরই ঘনিষ্ঠ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন সাহিত্যিক যখন নিজের কলম দিয়ে পণ্যের গুণগান করতেন, তখন বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতো কেবল পণ্য বিক্রির হাতিয়ার নয়, বরং এক ধরনের শিল্পও।