
সাজিদ আনাম:
ইতিহাসের প্রাচীনতম অধ্যায়ে, যখন মানবসভ্যতা ধীরে ধীরে সংগঠিত সমাজব্যবস্থা, নগরায়ণ ও লেখার চর্চার দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই উর শহরের এক নারী অসাধারণ কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি কেবল একজন কবি নন, বরং ছিলেন পুরোহিত, প্রশাসক এবং এক সাংস্কৃতিক রূপান্তরের মুখ্য পরিকল্পনাকারী। তার নাম – এনহেদুয়ানা। বিশ্বসাহিত্যে তিনি ‘প্রথম পরিচিত মহিলা কবি’ হিসেবে খ্যাত, যিনি নিজের নাম যুক্ত করে সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তার পরিচিতি সীমিত নয় শুধু নারীদের অগ্রদূত হিসেবে, বরং মেসোপটেমীয় সভ্যতার এক গৌরবময় প্রতীক হিসেবেও তিনি অমর হয়ে আছেন।
এনহেদুয়ানার নামের ব্যুৎপত্তি
এনহেদুয়ানা নামটি এসেছে সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপি থেকে – । ‘এন’ অর্থ ‘মহাযাজিকা’, ‘হেদু’ মানে ‘অলংকার’, এবং ‘আনা’ বোঝায় ‘স্বর্গ’। এই নামটির অনুবাদ দাঁড়ায় – ‘স্বর্গের অলংকারে বিভূষিত যাজিকা’। তার নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অবস্থানের ইঙ্গিত।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
খ্রিস্টপূর্ব ২২৮৬ অব্দে, মেসোপটেমিয়ার উর শহরে জন্মগ্রহণ করেন এনহেদুয়ানা। প্রচলিত মতানুসারে, তিনি আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট সার্গন দ্য গ্রেটের কন্যা। যদিও কিছু ইতিহাসবিদ তার পিতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন, তবুও প্রায় সকলেই একমত – এনহেদুয়ানাকে বিশেষ সম্মান ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল রাজশাসনের কৌশলগত প্রয়োজনে। সার্গন নিজে একজন সেনাপতি ও দিগ্বিজয়ী, তার কন্যা এনহেদুয়ানা ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিজয়ের দূত।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ
এনহেদুয়ানা সুমেরীয় ও আক্কাদীয় – উভয় ভাষাতেই দক্ষ ছিলেন। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় নারীশিক্ষা খুবই সীমিত ছিল, কিন্তু রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে এনহেদুয়ানা ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি কেবল কাব্যচর্চায় পারদর্শী ছিলেন না, গণিত, ধর্ম, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও রাজনীতি – এসব শাস্ত্রেও ছিল তার সমান দখল। তিনি ছিলেন তৎকালীন কালের সর্বোচ্চ শিক্ষিত নারী, যার প্রভাব রাজনীতি ও ধর্মের দুটো ক্ষেত্রেই ছিল দুর্দান্ত।
উরের মহাযাজিকা ও চন্দ্রদেব নান্নার প্রধান পুরোহিতা
সম্রাট সার্গন তার কন্যাকে উর শহরের ‘নান্নার’ (চন্দ্রদেবতা) মন্দিরে প্রধান পুরোহিত নিযুক্ত করেন। এটি নিছক একটি ধর্মীয় পদ নয় – বরং ধর্ম, প্রশাসন, কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সংহতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এ দায়িত্ব। এনহেদুয়ানার কর্তৃত্ব ছিল উর শহরের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনজুড়ে। তিনি এই পদে বসেই আক্কাদীয় এবং সুমেরীয় ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন।
ধর্ম ও রাজনীতির সংমিশ্রণ
সার্গন জানতেন, একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে কেবল সেনাশক্তি যথেষ্ট নয় – প্রয়োজন সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং ধর্মীয় বৈধতা। এনহেদুয়ানা সেই দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেন। তিনি ইনানাকে (ভেনাস বা ইশতার) কেন্দ্র করে নতুন এক ধর্মীয় বয়ান তৈরি করেন – যেখানে দেবতারা মানুষের মতো আবেগ-অনুভূতির অধিকারী। এই দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দেবতাদের মানুষের জীবনের অংশ করে তোলেন তিনি। এর ফলে ধর্ম আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে, যা জনসাধারণের মাঝে গভীর প্রভাব ফেলে।
৭. সাহিত্যকর্ম ও কাব্যিক কীর্তি
এনহেদুয়ানার রচনার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তিনটি স্তোত্র:
নিনমেসারা (In-nin-me-sara) – ইনানার মহিমা ও শৌর্য কীর্তন
ইন্নিনমেহুসা (In-nin-me-hus-a) – ইনানার গোপন শক্তি ও রুদ্র রূপের বর্ণনা
ইন্নিনসাগুরা (In-nin-sa-gur-ra) – দেবীর হৃদয়ের উজ্জ্বলতা ও ক্ষমাশীলতার চিত্রায়ন
এই রচনাগুলো ছিল শুধুমাত্র ধর্মীয় নয় – এগুলো রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। ইনানার প্রশংসার আড়ালে এনহেদুয়ানা সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সার্গনের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতেন।
রোমান্টিক ও নারীবাদী প্রেক্ষাপট
এনহেদুয়ানার কবিতাগুলোয় যৌনতা, প্রেম, আবেগ এবং নারীসত্তার গৌরবময় প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ইনানার শক্তি পুরুষ দেবতাদের চেয়েও বেশি বলে উপস্থাপিত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে বিশ্বের প্রাচীনতম নারীবাদী লেখক বললে ভুল হবে না। যৌনতা, কামনা, ক্ষমতা ও ক্ষমাশীলতার জটিল সংমিশ্রণে তৈরি তার কাব্য এক আধুনিক নারীবোধেরও পূর্বসূরি।
শাসনকর্মে ভূমিকা ও নগর ব্যবস্থাপনা
উরের মহাযাজিকা হিসেবে এনহেদুয়ানা শুধু ধর্মীয় রীতিনীতিই পরিচালনা করতেন না; তিনি নগর পরিকল্পনা, বাজার ব্যবস্থাপনা, সেচব্যবস্থা ও শস্য সংগ্রহের দিকগুলোতেও যুক্ত ছিলেন। উরের প্রায় ৩৪ হাজার অধিবাসীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জলের যোগান রক্ষা এবং বিশৃঙ্খলা ঠেকানো ছিল তার নিয়মিত কাজ। সেই সময় নারীর এমন শাসন ক্ষমতায় থাকা ছিল চরম ব্যতিক্রম, আর এনহেদুয়ানা সেই ব্যতিক্রমকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন।
রাজনীতি ও নির্বাসন
সার্গনের মৃত্যুর পর আক্কাদ সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহী নেতা লুগাল-আনে ক্ষমতা দখল করেন এবং এনহেদুয়ানাকে তার পদচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠান। তার একটি কবিতায় (যা সম্ভবত আত্মজীবনীমূলক) তিনি এই নির্বাসনকাল ও মানসিক যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন – এটি সাহিত্য ইতিহাসের প্রথম আত্মজৈবনিক নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন। পরবর্তীতে সার্গনের দৌহিত্র নারাম-সিন বিদ্রোহ দমন করে এনহেদুয়ানাকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনেন।
সাহিত্যকীর্তির বিস্তার ও উত্তরাধিকার
এনহেদুয়ানার রচনাগুলো পরবর্তী পাঁচ শতাব্দী ধরে সুমেরীয় ও আক্কাদীয় বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তার রচনার অনুলিপি পাওয়া গেছে পরবর্তী প্রজন্মের কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে। এমনকি হিব্রু বাইবেল এবং হোমারের মহাকাব্যেও তার প্রভাব অনুধাবন করা যায় – যদিও এই বিষয়টি আলোচনার পর্যায়েই আছে।
পুনরাবিষ্কার
১৮৭০ এর দশকে মেসোপটেমিয়ার ধ্বংসাবশেষে খননকাজ শুরু হয়। ১৯২৭ সালে বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্ড উলি উর শহরের মন্দিরে একটি চাকতি আকৃতির মৃত্তিকা ফলক আবিষ্কার করেন, যেখানে প্রথমবারের মতো ‘এনহেদুয়ানা’ নামটি পাওয়া যায়। এরপর ধীরে ধীরে তার কীর্তি পুনরায় আলোচনায় আসে।
উপসংহার
সার্গনকন্যা এনহেদুয়ানা শুধু একজন কবি ছিলেন না – তিনি ছিলেন এক সভ্যতার নির্মাতা, এক নারীর প্রতীক যিনি ধর্ম, রাজনীতি ও সাহিত্যকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। তিনি সাহিত্য জগতে নারীদের উপস্থিতির সূচনা করেছিলেন এবং মানবসভ্যতার প্রথম সাহিত্যিক কণ্ঠস্বর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন।
আজ যখন আমরা নারীর ক্ষমতায়ন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মিলনের কথা বলি, তখন এনহেদুয়ানা আমাদের শেকড়ের স্মারক হিসেবে ফিরে আসেন। তার লেখা প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি স্তোত্র কেবল ইতিহাসের দলিল নয় – বরং এক নারী কণ্ঠের অনুরণন, যা হাজার বছর পেরিয়েও এখনো আমাদের কানে বাজে।